বাংলাদেশে চারুকলার ধারা এবং শিল্পীদের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশে চারুকলার ধারা এবং শিল্পীদের ভবিষ্যৎ

আমার পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরে হলেও শৈশব কেটেছে কিশোরগঞ্জ। তখন কিশোরগঞ্জ ছোট্ট একটা মহকুমা। জলরং বলে কিছু আছে সেটাই জানতাম না। জলরং, তেলরঙের টিউব হয় জানাই ছিল না। এ অবস্থা থেকে ঢাকায় আসার পর এ জগৎটা দেখলাম। তখন সেই মহকুমা শহরে আর্ট ছিল না এমন নয়। ঈদ বা পূজায় কাগজ কেটে সাজান। ভুসাকালি ভাতের মাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে পুরনো খবরের কাগজ রাঙানো। আরও ছিল রুরাল আর্ট, রিকশার পেছনের ছবি। বড় বড় সিনেমার ব্যানার হতো। সেটা অপূর্ব আর্ট ছিল। সেই কাজে ক্রিয়েটিভিটি ছিল। ঢাকার ঝুলন বাড়িতে সিনেমার ব্যানার আঁকার একটা কারখানা ছিল। শিল্পী ছিলেন বগুড়ার এ জেড পাশা। ঢাকার প্রায় সব সিনেমা হলের জন্য ঢাউশ আকারের দৃষ্টিনন্দন ব্যানার আঁকতেন তিনি। কামার্ট নামে সিনেমার পোস্টার আঁকার এবং ছাপানোর একটা কোম্পানি ছিল শিল্পী সুভাষ দত্তের। তিনিও বগুড়ার অধিবাসী। পরবর্তীকালে অভিনেতা ও চিত্রনির্মাতা হিসেবে খুব নাম করেছিলেন। আর্ট কলেজের শিল্পীরাও সারভাইবের জন্য সিনেমার ব্যানার আঁকার কাজ করত। তখন তো ছবি বিক্রি হতো না। শিল্পী নিতুন কুন্ডু সিনেমার ব্যানার আঁকতেন। নিতুন কুন্ডু অটোবি ফার্নিচারের মালিক ছিলেন। তিনি ভালো আর্টিস্ট, অলরাউন্ডার এবং ইন্টেলিজেন্ট ছিলেন। আশিষ বলে ভালো একজন আর্টিস্ট ছিলেন শিল্পী হাসেম খানদের ব্যাচের। তিনিও সিনেমার ব্যানার আঁকতেন। সেগুলো অপূর্ব ছিলেন। সেগুলো দেখে ভাবতাম কত সুন্দর আর্ট হয়। সেটা ছিল গণমানুষের শিল্পকলা। সেটা বলছি ৬০-৭০ বছর আগের কথা। ৫০ বছর আগে একটি মহকুমায় আর্ট শেখাবে সেটা অসম্ভব ছিল। তখন চারুকলায় ৮০ শতাংশই ছিল গ্রামের ছাত্র। এখন তো আর্ট কলেজ হয়েছে অনেক জেলায়।

 

 

 

ঢাকায় আসার পর আমরা তেমন কোনো অয়েল পেইন্টিং দেখিনি। এখানে সিনিয়রদের কাজ দেখতাম। তখন ঢাকায় কোনো গ্যালারি ছিল না। আর্টশপ ছিল, সেটা আসলে গ্যালারি নয়। তার মধ্যে প্রথমেই সাজু আর্ট গ্যালারির কথা বলতে হবে। সেটা গ্যালারি হোক আর আর্টশপ হোক আর্টিস্টদের ছবি বিক্রি করে খুব সহায়তা করেছে। তখন ছবি কিনতেন ৯০ শতাংশ বিদেশি। বাঙালিরা ছবি কিনবে এমন দেখিনি। বলছি বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কথা। তখন অল্প দামে ছবি বিক্রি হতো। জয়নুল আবেদিন সাহেবের ছবি বিক্রি হতো চার-পাঁচ হাজার টাকায়। বাকিদের ছবি বিক্রি হতো এক-দুই হাজার টাকায়। তখন বার্ষিক প্রদর্শনী হতো। সেখানে আমরা ওয়াটার কালার দিতাম। আমরা ওয়াটার কালার করতাম আউটডোরে গিয়ে। এখন ওয়াটার কালার আউটডোরে কম করা হয়। কিছু কিছু ওয়ার্কশপ বাইরে নিয়ে করায়।

 

 

আমি এখনও বিশ্বাস করি আর্টিস্টকে অবশ্যই নেচার স্টাডি করতে হবে। নেচারে ছবি আকার যে আমেজ সেটা ঘরে বসে আঁকা সম্ভব নয়। নেচার প্রতি মুহূর্তে চেঞ্জ হচ্ছে। দুপুরে এক রকম লাইট, বিকালে এক রকম লাইট। এগুলো নেচার স্টাডি না করলে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা যতই পারফেক্ট বলি, আসলে পারফেক্ট বলে কিছু নেই। সবুজ একটা গাছ দূরে গিয়ে দেখলে নীল দেখায়। পাহাড় দূর থেকে নীল দেখায়। কাছে গেলে সবুজ গাছে মোড়ানো দেখা যায়। আমি কক্সবাজারে সাগরের অনেক ছবি এঁকেছি। সাগরের পানির রং সকালে এক রকম, দুপুরে আরেক রকম, বিকালে আবার অন্যরকম। আসলে আমরা নেচার থেকেই সব এলিমেন্ট নিচ্ছি। নেচারই আমাদের শিক্ষক।

 

 

আমাদের ছাত্রজীবনে প্রথম এক্সিবিশন দেখলাম মুর্তজা বশীরের। আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর তখন ইতালি থেকে এসেছেন। আমিনুল ইসলাম আমাদের প্রফেসর ছিলেন। মুর্তজা বশীর তখন শিক্ষকতা করেননি। কাইয়ুম চৌধুরী তখন ডিজাইন সেন্টারে কাজ করতেন। সেই সময়ে রিয়ালিস্টিক কাজ হতো। এখন আমরা ওয়েস্টার্ন ইনফ্লুন্সে কাজ করছি। আমরা আর্ট কলেজে পড়েছি রয়েল স্কুল অব আর্টের সিলেবাস নিয়ে। সেখানে আমাদের বেসিক জ্ঞান দেয়া হতো স্কেচ, জলরং, ফিগার ড্রইং, স্টিল লাইফ করিয়ে। সেটা আর্টের ল্যাঙ্গুয়েজ। আরও আছে চারকোল, প্রিন্ট মাধ্যমে এচিং, উডকাট। সিরামিক আবার অন্য ল্যাঙ্গুয়েজ। যে মাধ্যমেই কাজ করি না কেন, বেসিকালি আর্টিস্ট তার থটটাকেই দিচ্ছে।

 

আমি ১৯৬১ থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত আর্ট কলেজে শিক্ষার্থী থাকাকালে নেচার স্টাডি করেছি। তখন ল্যান্ডস্কেপ বেশি করা হতো। বিভিন্ন কম্পোজিশন করতাম। তখন দেখতাম আর্টিস্টরা ইজেল নিয়ে বাইরে কাজ করছেন। বিভিন্ন সময়ে আমরা গ্রুপ করে আউটডোর করতাম। রায়েরবাজার চলে যেতাম। তখন ঢাকায় স্পেস ছিল। সাইকেলে করে বোর্ড নিয়ে চলে যেতাম। সেই সময় গোটা বাংলাদেশে ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ। ৫০ বছর পর সেখানে এখন লোকসংখ্যা ষোল-সতেরো কোটি। এখন আমাদের ছবি আঁকার স্পেস কমে গেছে। ছবি আঁকতে যেতে হয় বাইরে গ্রামের দিকে। সেজন্য আর্টিস্টরা এখন ইন্ডোর ছবি আঁকেন বেশি। তারপর আর্ট এখন গ্লোবালাইজ হয়ে গেছে। আমি আমিনুল ইসলামের একটি এক্রিলিকে আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হই আমার ছাত্রজীবনে। সেই প্রথম এক্রিলিকে করা কাজ দেখি। শিল্পকলা একাডেমিতে সুন্দর এক্রিলিকে আঁকা একটা কাজ ছিল। এখন তো ৯০ শতাংশ শিল্পী এক্রিলিকে কাজ করেন। এই যে নতুন নতুন মেটেরিয়াল আর্টে ঢুকছে। ফাইভার গ্লাস, বিভিন্ন ধরনের বার্নিশ, এক্রিলিক এগুলো টেকলিক্যাল এলিমেন্ট হিসেবে এখন আর্টকে ডোমিনেইট করছে।

 

 

আমি চলে গেলাম স্পেনে। ১০ বছর পর এলাম। তখন এচিংটা ছিল খুব সীমাবদ্ধ। এচিংই আমার মেইন বিষয়। ৪০ বছর এচিং করলাম। ঢাকায় থাকতে দুটি লিথোগ্রাফ করছিলাম। বেরি ক্লাসিকাল মেথড। এখন অনেক টেকনিক হয়ে গেছে। এখন পাথর বাদ দিয়ে অফসেট প্লেটে করা হয়। এচিং, উডকাট, লিথো এগুলো সবই ছাপচিত্র। খবরের কাগজে যেমন মেকানাইজড ছাপা হয়। আমরা করি আর্টিস্টিক ওয়েতে। এটার পেপার হেভি এবং অন্যরকম হয়ে থাকে। পরে সিল্কস স্কিন এলো। এটা কমার্শিয়াল টেকনিক। যেমন পেন্সিল, লাইটার, ট্রেনের দরজায় কমার্শিয়ালি কাজ করা হয়। ক্যামেরায় নাম লেখা অন্য ধরনের মিডিয়া। এগুলোকে গ্রাফিক আর্ট বলে। এচিং, উডকাট, লিথোগ্রাফি, সিল্কসস্কিন এগুলো গ্রাফিকস আর্টে পড়ে। এগুলো কপি হয়। এগুলো ছাপাখানার মতো একটার পর একটা হয় না। একটা প্রিন্ট করে আবার প্লেট পরিষ্কার করে, রং লাগিয়ে আরেকটা প্রিন্ট নিতে হয়। এক একটা আবার এক এক টেকনিকে করতে হয়। অনেক ওয়েতে এচিং করা যায়। জিংক প্লেটে, কপার প্লেটে।

 

 

এখানে ছাপচিত্র নিয়ে কিবরিয়া মেলা হয়। এটা অনেক বড় এতটি কাজ। এদেশে অনেকেই প্রিন্ট সম্পর্কে জানেন না। এমনকি অনেক বায়ার ও শিল্পপ্রেমী এ বিষয়ে কম জানেন। কিবরিয়া মেলায় একটা প্রিন্ট মেশিন লাগিয়ে দেখাতে পারে আর্টের প্রিন্ট সাধারণ প্রিন্টের মতো নয়। এখানে একটা কাজের ৫০-৬০টি প্রিন্ট নেয়া হলেও সেখানে পরিশ্রম ও দক্ষতার পরিচয় থাকে প্রতিটি কাজে। সব প্রিন্ট নেয়ার পর প্লেটটি ডেস্ট্রয় করা হয়। এ আর্ট মাধ্যমকে বলা হয় সোশ্যালাইজড আর্ট।

 

 

আর্টটা ছিল ক্যাপিটালিস্ট, রাজাদের বিষয়। পাঁচশ বছর আগে রাজারা আর্টিস্ট পুষতেন। রেমব্রান্ড, গয়া তাদের কোর্ট পেইন্টার বলা হতো। রাজাদের বেডরুমে আঁকত। রাজপরিবারের ছবি আঁকতেন। তখন কোনো আর্ট স্কুল ছিল না। তারাই রং তৈরি করতেন, সেগুলো দিয়ে আঁকতেন। তখন তৈলচিত্র ছাড়া আর ছিল এগটেম্পরা। দেখা যায়, গয়ার ছবিতে এক রকম টোন ব্রাউন। রেসব্রান্ডের ছবিতে আরেক রকম। সেটা পার্থক্য হয়েছে এক এক দেশের পিগমেন্ট ও প্রকৃতি থেকে যে তেল ও রং পেয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে।

 

 

নেচার থেকে যে উপাদান নিয়ে ছবি এঁকেছে তার পার্থক্য থাকার কারণে ছবির টোনে পার্থক্য দেখা যায়। ছবি একটা সময়কে ধরে রাখে। পাঁচশ বছর আগে যেসব ছবি আঁকা হতো এখন সেগুলো খুব কম হয়। আসলে আঁকা হয় সবই। এখন ছবি আঁকার মাধ্যম অনেক। সব আর্টিস্টতো এক রকম ছবি আঁকে না। কেউ এবাস্ট্রাক, কেউ ক্লাসিকাল, রিয়ালিজম আছে, কেউ পোর্ট্রট করছেন, মেরিন আর্ট করছেন, ল্যান্ডস্কিপ্ট করছেন। এখন বেশিরভাগ আর্ট চলে গেছে ইন্টেলিজেন্সের ওপর। পৃথিবীতে অনেক আর্ট হচ্ছে। এ মুহূর্তে আমি কথা বলছি। হয়তো পৃথিবীতে তিন লাখ আর্টিস্ট কাজ করছেন। সবাই চান নতুন একটা কিছু করবে। নতুন চিন্তাধারা বের করতে। কিন্তু দেখা গেছে, আর্ট ওয়াল্ডে একটা ক্রাইসিস হয়। কখনও ২৫ বছর। কখনও ১০ বছর। কখনও বা পাঁচ বছর। এই সময় ধরে কোনো একটা বড় আর্টিস্ট বের হয় না।

 

 

বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনটা ব্যাপকভাবে শুরু হল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। এর আগে আমাদের আর্টিস্টদের বিদেশ গমন ছিল সীমিত। তখন কিবরিয়া (মোহাম্মদ কিবরিয়া) সাহেব গিয়েছিলেন জাপান। আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর গিয়েছিলেন ইতালিতে। শফিউদ্দিন (শফিউদ্দিন আহমেদ) সাহেব ছিলেন ইংল্যান্ডে। এরা কিন্তু নিজের খরচে বিদেশে গেছেন। তখন যে স্কলারশিপগুলো পূর্ব পাকিস্তানের কেউ পেত না। এখানেও ছিল আমাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। খবরের কাগছে বিজ্ঞাপন দিত সাত দিন আগে। দেখা গেছে, বিদেশ যাওয়া কাগজপত্র তৈরি করতেই সময় লাগত কয়েক মাস। বাঙালিরা যাতে বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে না যেতে পারে সেজন্য এটা করত। প্রথম যারা বিদেশ গিয়েছিলেন তারা এসে এবাস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত আর্ট শুরু করেন। তখনকার আর্ট দেখলে এখন বুঝতে পারি এই কাজে ইউরোপের আর্টিস্টদের ইনফুলেন্স আছে। বিশেষ করে পিকাসো, পলকি এদের ধারা। পিকাসো, পলকি এখন পর্যন্ত বড় মাপের আর্টিস্ট। তারা এখনও আছেন এবং থাকবেন ইতিহাসের পাতায়।

 

 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে নিজস্ব আর্টের জগৎ তৈরি হতে লাগল। ইয়াং আর্টিস্টরা ইন্ডিভিজুয়ালভাবে সারা পৃথিবীর আর্টের তথ্য পেতে লাগল। তারপর ইকোনমি গ্রোথের সঙ্গে সঙ্গে আর্টের গ্রো করতে লাগল। শিল্পকলা একাডেমি হল। অনেক আর্ট গ্যালারি হল। শিল্পাঙ্গন গ্যালারি, চিত্রক গ্যালারি হল। বেঙ্গল আর্ট গ্যালারি, তারপর গুলশানে অনেক ছোট ছোট গ্যালরি হল। আর্ট সবসময়ই ইকোনমির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। পাঁচশ বছর আগে রাজারা কোর্ট পেইন্টারদের পালত। পাঁচশ বছর পরে এসে চিন্তা করলে দেখা যায় সেই বিষয় থেকে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। আর্ট চলে গেছে ব্যাংকারদের হাতে, কর্পোরেটদের হাতে। ওরাই শিল্পকলাকে পেট্রোন করছে। প্রদর্শনীর ক্যাটালগ-ব্রুশিয়ার করতে গেলেও তাদের সহায়তা লাগে। একটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা আর্টিস্টদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তারা স্বাধীন চিন্তা করে ছবি আঁকতে পারে। তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ইউরোপের মিউজিয়ামে গেলে দেখা যায় সব বাইবেলিক ছবি। সেই সময়ে বাইবেলিক ছবি ছাড়া অন্য কোনো ছবি আঁকার উপায় ছিল না। সোশ্যাল লাইফ বা সাধারণ মানুষ নিয়ে কেউ কাজ করত না। এখন এ স্বাধীনতাটা ছাড়া অন্য কিছু চেঞ্জ হয়নি। এখন আর্টিস্ট নিজস্ব একটা চিন্তা নিয়ে ছবি আঁকতে পারে; যা ইচ্ছা তা আঁকতে পারে। বাধা দেয়ার কেউ নেই। এটাতো বিরাট পাওয়া।

 

 

বাংলাদেশে দেশের আর্ট জগৎ তৈরিতে গ্যালরিগুলোর বড় অবদান আছে। ফয়েজ ভাই (ফয়েজ আহমদ) লোকজনকে ছবি জোর করে কিনিয়েছেন। অবদান আছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। তারপর আসল বেঙ্গল গ্যালারি। আবুল খায়ের লিটুর অবদান অনেক। একটা গ্যালারি কী রকম হতে পারে সেটা দেখালেন তিনি। অ্যাপার্টমেন্টে ছবি প্রদর্শনের ঘর করলেই গ্যালারি হয় না। গ্যালারির আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। লাইটিং, ফ্লোর, ওয়াল সব মিলিয়ে তার অন্য রকম রুচি। বাংলাদেশের কনটেম্পরারি আর্টের সেটা অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। তারপর শিল্পকলা একাডেমি। কিছু দিন আগে মারা গেলেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। তিনিই এশিয়ান আর্ট ভিয়েনাল শুরু করেন। তখনই তার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লুক ছিল। তিনি বাংলা-ইংরেজি ভাষা বলতে পারতেন। তার ভেতরটা ছিল এলিট শ্রেণীর। বাংলদেশে যেখানে কোনো গ্যালারি ছিল না। সেখানে ত্রিশ-চল্লিশটা দেশের শিল্পীদের নিয়ে আর্ট প্রদর্শিত হয়েছিল। এ ছবিগুলো দেখা দেশে আর্টিস্টদের অনেক বড় পাওয়া। তারপর আসল সামদানী। সামদানী আর্ট ফেয়ার করে দেখাল রিয়াল আর্ট ফেয়ার অন্য জিনিস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মান নিয়ন্ত্রণ করে সামদানী এই আয়োজন করে থাকে। এর ভেতর বিভিন্ন রকমের আর্ট থাকে। আর্ট এখন গ্লোবালাইজড হয়ে যাচ্ছে। যদিও আমি গ্লোবালাইজেশর পক্ষপাতী নই।

 

 

আমাদের শিল্প আন্দোলনে ৭০ বছর পূর্ণ হল। এখনে এসে আমি বলব আর্ট হল নতুন কিছু খোঁজা। নিজের অভ্যাসের বাইরে দেখা, চিন্তা করা। আমরা লিমিটেড, তবুও কাজ করে যাচ্ছি। নতুন কিছু করতে চাইলে অন্য দেশগুলো কী করছে তার খবর রাখতে হবে। তারা কোন ওয়েভে যাচ্ছে। শিল্পকলা সামনে আগায়। কতগুলো আছে ডেথ আর্ট। সেগুলো মরে গেছে অনেক আগে। এগুলো নিয়ে চর্চা করার কিছুই নেই। আমি আগেই বলেছি আর্ট হচ্ছে একটা সময়কে ধরে রাখা। আমাদের মাস্টার পেইন্টারদের ছবি দেখে সেই সময়টাকে বুঝতে পারছি। বিদেশি অনেক বড় পেইন্টারের ছবি এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। কয়েক বছর আগে বেঙ্গল গ্যালারিতে গয়ার এচিং প্রদর্শিত হয়েছে। আমাদের গুলোও প্রদর্শিত হচ্ছে বিদেশে। এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মিজরুল কায়েসের বড় অবদান আছে। ছবি কেনা আর্টিস্টকে একটা অক্সিজেন দেয়া। অনেক আর্টিস্ট ছবি বিক্রি না হলে ছবি আঁকতে উৎসাহ পান না।

 

 

আমাদের ছবির কালেকশনও আস্তে আস্তে হলেও গ্রো করেছে। এখন ইয়াং কালেক্টররাই বেশি সংগ্রহ করছে। কালেক্টরদের হয় কী, একটা সময়ে এসে দেখে তার বাড়িতে আর ছবি রাখার জায়গা নেই। যার কারণে পুরনো কালেক্টররা সংগ্রহ করতে সাহস পায় না। এই কালেকশনের দায়িত্ব নিতে হবে কর্পোরেট অফিসগুলোকে। প্রাইভেট সেক্টরে কিছু ইয়াং গার্মেন্ট ব্যবসায়ী গত ২০ বছর ধরে তারই বেশি পেইন্টিং কিনেছে। ইয়াং কালেক্টরদের একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সেটা ফ্রেন্ডশিপের জন্য হোক, দেখা দেখিতে হলেও ছবি কেনার কালচারটা গ্রো করেছেন। এটা আর্টিস্টদের জন্য খুবই ভালো। এর মধ্যে অনেক গ্যালারি হয়েছে ঢাকায়। চিটাগাং, খুলনায় হয়েছে। এটা খুবই শুভ লক্ষণ। আমি বলব গত ১০ বছরে নতুন প্রজন্মের আর্টের যে পরিবর্তন, আর্টের ল্যাঙ্গুয়েজ অনেক ধরনের হয়েছে। পারফরমেন্স আর্ট এসেছে। আমাদের সময় এর নামও সুনিনি। তারপর আছে কন্সেফচুয়াল আর্ট। ভিডিও আর্ট, ইলেক্ট্রনিক আর্ট। সামদানী আর্ট সমিট এবং এশিয়ান ভিয়েনালে সে কাজ আমরা দেখতে পারছি। সরাসরি দেখা যাচ্ছে এ নিয়ে অন্য দেশে কী করে। আর্টের এই পরিবর্তন হচ্ছে কোথাও চিন্তাধারা, কোথাও মেটিরিয়া, কোথাও ফর্মে। এ নিয়ে সেমিনারও হচ্ছে। আমি বলব এটা কিন্তু খুবই প্রফেসনাল এবং পজেটিভ। বিশেষ করে বাংলাদেশে ইয়াংরা যা করছে আমি বলব তারা খুব সাহস নিয়ে কাজ করছে।

 

 

এটার একটা কারণও আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের চেয়ে অনেক ভালো কাজ করছে তারা। কারণ সেখানে একটা ট্রেডিশনের ব্যাপার আছে। একটা দেশের স্ট্রং ট্রেডিশন হলে সেটা থেকে বের হওয়া মুশকিল। কালচারটা তখন ভাঙা যায় না, মাথায় থেকে যায়। রিলিজিয়াস বুক আছে, স্টোরি আছে। সবসময় স্টোরি নিয়ে ছবি আঁকা যায় না। বাঙালিদের যেহেতু এত বেশি বিষয় ছিল না। নতুন দেশে ইয়াংরা নতুন করেই চিন্তা করছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ভেনিস ভিয়েনালে গেল। ইন্ডিয়াও প্রথম গেল। এটা বিরাট পাওয়া। ভেনিস ভিয়েনাল ওয়াল্ডে বিরাট একটা বিষয়। সেখানে সরা পৃথিবীকে দেখানো যায় নিজের দেশের কাজ। সেটা থাকে ছয় মাসের জন্য। এটা একটা প্রেস্টিজিয়াস ভিয়েনাল। সেখানে বাঙালি আর্টিস্টরা যাচ্ছে। সেখানে যায় বিভিন্ন দেশের কালেক্টর, গ্যালারি, আর্টলাভার। সেখানেই অনেকে দেখেছে বাংলাদেশের আর্ট।

 

 

অনেকের ধারণা ছিল বাংলাদেশে তো ঝড়-তুফান-বন্যা হয়। অনেক মানুষ মারা যয়। সেখানে আর্ট হবে কী করে। এশিয়ান ভিয়েনাল, সামদানী আর্ট সামিটে বিভিন্ন দেশের আর্টলাভাররা, আর্টিস্ট, আর্টক্রিটিকরা আসেন। ওরা দেখে যান বাংলাদেশে ভালো কাজ হচ্ছে। এটাও বিরাট পাওয়া।

 

 

পৃথিবীজুড়েই নানা রকম কাজ করছেন আর্টিস্টরা। কালেক্টরদের রুচির ভিন্নতা আছে। কেউ বিমূর্ত ছবি পছন্দ করে। কেউ মডার্ন আর্ট। কেউ কালেক্ট করে পোর্ট্রেট। কেউ আবার ল্যান্ডস্কেপ। সব দেশেই নানা রকম বিষয় নিয়ে কাজ করেন আর্টিস্টার। অনেকে বলে ছবি বিক্রি হয় না। আমি তো দেখছি যারা কন্টিনিউয়াস কাজ করেন তাদের ছবি বিক্রি হয়। কোন দেশেই সব আর্টিস্টের ছবি বিক্রি হয় না। যাদের বিক্রি হয়, ভালোভাবেই হয়। যাদের হয় না, তাদের হয়ই না।

 

 

বাঙালিরা একটু অতিরঞ্জিত করেই তাদের শিল্পীদের পৃথিবী বিখ্যাত ভাবেন। এটা বলাটা আমার কাছে লজ্জার বিষয় মনে হয়। পেইন্টাররা সবসময় হাইডিং অবস্থায় থাকে। ক্যানভাসের পেছনে লুকানো থাকে। পৃথিবী বিখ্যাত বলা কঠিন বিষয়। কারণ পৃথিবীটাতো বড়। মকবুল ফিদা হোসেনের কথাই যদি বলি। ভারতের সবাই তাকে চেনে। কিন্তু পৃথিবীর কেউ তাকে চেনেনা। চেনে আমেরিকাতে। সেখানে কিছু মাড়োয়ারি বায়ার আছে। মাড়োয়ারি যারা আমেরিকায় ধনী হয়েছে তারা চায় ইন্ডিয়ান পেইন্টিং। অকশন সেলাররা দেখে মার্কেট। তারা প্রমোশনের জন্য করে না। যখন দেখে বায়ার রেডি, তখন সেই দেশগুলোর কাজ অকশনে আনে।

 

 

এটাও বড় বিষয়, আমাদের জয়নুল আবেদিন সাহেবের ছবি অনেক দামে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড আর্ট হিস্ট্রিতে আমাদের কারও নাম নেই। বিশাল ভারতের দু-একজন ছাড়া কারও নাম নেই। কনটেম্পরারি আর্টে আনিশ কাপুরের নাম আছে। তিনি মিক্সড ইন্ডিয়ান। আসলে এখানে পৃথিবী বিখ্যাত কেউ নেই। আমি অনেক বছর বিদেশে আছি। আমার আশপাশে একটা সার্কেল করে নিয়েছি। একটা মার্কেটও করে নিয়েছি। স্পেন সরকারের কাছ থেকে অনেক পেয়েছি। তবে একটা কথা বলে রাখি, এই আমি ভিন দেশে এতগুলো বছর টিকে আছি, এটা কিন্তু ছোট করে দেখার উপায় নেই। এটা অবশ্যই বড় একটা বিষয়।

 

 

আমাদের অনেক খ্যাতিমান আর্টিস্ট মারা গেছেন। এখন কেউ তাদের নামও নেয় না। তাদের ছবিও দেখা যায় না। শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে, শিল্পীর কাজ বাঁচিয়ে রাখতে ভালো মানের পাবলিকেশন করতে হবে। প্রচুর পাবলিকেশন করতে হবে। প্রাইভেট চিত্রশালা না হলে শিল্পীদের কাজ টিকে থাকবে না। নাইলে সব মুছে যাবে।

 

 

 

সূত্রঃ (মনিরুল ইসলাম) দৈনিক যুগান্তর

ছবিঃ সংগৃহীত