একজন আলোকচিত্রী'র চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে ওঠার গল্প...

একজন আলোকচিত্রী'র চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে ওঠার গল্প...

দীর্ঘ ১৫ বছর প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হিসাবে ছবি তোলার মাধ্যমে জাহিদুর রহমান বিপ্লব বাংলাদেশের মৌলিক সৌন্দর্য্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযাপনসহ সর্বোপরি বাংলাদেশকে ধারণ করেন একটি নান্দনিক ফ্রেমে যার বহিঃপ্রকাশ তিনি দেখাতে চান।

 

স্থিরচিত্রের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন গত ৭/৮ বছর ধরে মনে-প্রাণে লালন করছেন জাহিদুর রহমান বিপ্লব। তিনি বলেন, দেশকে ভালোবাসা বা দেশের জন্য ভালো কিছু করার নিমিত্তে প্রথাগত চেয়ার বা পজিশনের দরকার পড়ে না; দরকার পড়ে নির্ভেজাল মানসিকতা, সততা ও দেশপ্রেম!' সেই ধারাবাহিকতা থেকে এই ফটোগ্রাফার মনোনিবেশ করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। কাহিনি ভালো হওয়ায় প্রথম চলচ্চিত্রেই অর্জন করেছেন সরকারি অনুদান।

 

২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে সরকারি অনুদানের জন্য মনোনীত হয়েছে জাহিদুর রহমান বিপ্লবের পরিচালনায় ‘ওমর ফারুকের মা’ স্বল্পদৈর্ঘ্য (৩৫-৪০ মিনিট) চলচ্চিত্র। সংগ্রহিত কাহিনীটি মুক্তিযুদ্ধের একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে মূলভাবনা, গল্প, পরিচালনা, প্রযোজক, ক্যামেরা পরিচালনা ও সিনেমাটোগ্রাফি জাহিদুর রহমান বিপ্লবের নিজের। চিত্রনাট্য করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার মাসুম রেজা। গল্পটা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও বর্তমানের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আবর্তিত। প্রধান চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুকের মা। যুদ্ধ শেষে ওমর ফারুক আর ফিরে আসেনি। কিন্তু মা এখনো বিশ্বাস করে তার সন্তান একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।

 

গল্পটি পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ স্বরূপকাঠি উপজেলার স্বরূপকাঠি নামক স্থানের একজন মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক আর তার মায়ের। ২১ বছরের যুবক ওমর ফারুক ছিলেন পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। ওমর ফারুক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নির্ভীক যোদ্ধা স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে ওমর ফারুক যোগ দেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গ্রুপে। ১৯৭১ সালে ২৩ মার্চ পিরোজপুরের টাউন ক্লাব চত্বরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ওমর ফারুক, পুড়িয়ে ফেলেন শহরের যত পাকিস্তানী পতাকা। ঐদিন সন্ধ্যায় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পিরোজপুরের ট্রেজারি ভেঙে লুট করেন অস্ত্র। আত্মগোপনে থেকে সুসংগঠিত করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধের সময় এক রাতে মাকে কথা দিয়ে গিয়েছিল রাত্রে ফিরে মায়ের হাতে ভাত খাবে। ওমর ফারুকের আর ফেরা হয়নি। ৪৬ বছর পেরিয়ে গেছে, পার হয় নাই ওমর ফারুকের মায়ের অপেক্ষা! মা আজও ছেলের অপেক্ষায় তিনবেলা হাঁড়িতে ভাত বসান, রাতে সদর দরজা খোলা রাখেন ছেলের অপেক্ষায়, ছেলে আসবে সেই বিশ্বাসে!

 

ওমর ফারুকের সাথে নদী নামের একটি মেয়ের প্রণয় ছিল কলেজে পড়ার সময়, যে ওমর ফারুকের মায়ের সাথে তার সারাজীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে ওমর ফারুকের স্ত্রীর আসনে সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলছে নদী! নদী জানে ওমর ফারুক আর ফিরে আসবে না আর তাই সে ওমর ফারুকের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করে চলছে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, নারী অধিকারসহ নানান সামাজিক কার্যক্রমে!  এমনিভাবেই এগোতে থাকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওমর ফারুকের মা’ এর কাহিনি। চলচ্চিত্রটির পরিচালক জাহিদুর রহমান বিপ্লব নেহাত শখের বশে ২০০২ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট থেকে একমাসের একটি শর্ট কোর্স বেসিক ফটোগ্রাফির উপর।

 

২০০৩ সালে বিয়ে পর জীবিকার প্রয়োজনেই প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি দিকে যাত্রা শুরু। স্বাধীনচেতা এই আলোকচিত্রী প্রথাগত লেখাপড়া এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি তার কর্মজীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন আলোকচিত্রের ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে।

 

 

যেভাবে ফটোগ্রাফিতে আসা:

ছোটবেলা থেকেই থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল তার; তবে সেটা বেশি কাজ করতো ক্যামেরার সামনে নিজেকে দেখার জন্য! ১৯৯৫ সাল, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শখ মেটাতে তার বাবা তাকে Yashica camera dx কিনে দেন ( অটোমেটিক, পয়েন্ট এন্ড শুট ক্যামেরা)। তখন থেকেই ভালোলাগার যেকোনো বিষয়বস্তুর ছবি তোলা শুরু। ১৯৯৮ সালে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা শেষ সময়ে হঠাৎ ভারতের বন্যার প্রকোপ যশোর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো আক্রান্ত হয়; হঠাৎই ছবি তোলার নেশা কাজ করা শুরু করে তার মধ্যে। অনেক ছবি তুলেছিল বাবার দেওয়া সেই অটোমেটিক ক্যামেরা দিয়ে। ছবি তোলা শুরু তখন থেকেই যার ধারাবাহিকতায় নিতান্তই শখের বসে ২০০২ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট থেকে একমাসের একটি শর্ট কোর্স বেসিক ফটোগ্রাফির উপর। ২০০২, তার প্রথম এস এল আর ক্যামেরা Vivitar V ৩৮০০N.

 

আলোকচিত্র থেকে চলচ্চিত্রে কেনো?

জাহিদুর রহমান বিপ্লব বলেন, একটি ছবি বা সিরিজ অফ ফটোগ্রাফ দিয়ে ভাবপ্রকাশ/নিজের মতাদর্শ প্রকাশের ব্যাপারটা সীমিত; আমার মনে হয়! সেখান থেকেই ভিস্যুয়ালের প্রতি একটা ঝোঁক গত ৭/৮ বছর ধরে। ফিল্মের উপর একটা গ্রাজুয়েশন নিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিতে ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমীতে ( আমেরিকা) ভর্তি হই ; যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করি কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত আমেরিকান এমবাসী আমার ভিসা প্রত্যাখ্যান করে! পড়তে যাওয়া হলো না আমার!

 

 

তিনি বলেন, হাবিব আঙ্কেল (হাবিবুর রহমান খান), আশীর্বাদ চলচ্চিত্র আমার এই পড়তে যাওয়ার বিষয়টি জানতেন; আমাকে হতাশ হতে নিরুৎসাহিত করেন তিনি, আমাকে উৎসাহ দেন যে গৌতম ঘোষের (ফিল্মমেকার/ চিত্র পরিচালক, ইন্ডিয়া) সাথে কাজ করতে। ''শঙ্খচিল; গৌতম ঘোষের এই প্রোডাকশনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি তার সাথে কাজ করি এই মুভিতে। উনার সাথে এই প্রোডাকশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আর শেখার জায়গাটি আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছে ফিল্মমেকিংয়ে। গৌতম ঘোষ ফিল্মের জগতে আন্তর্জাতিকভাবে অতিপরিচিত একজন সফল ফিল্মমেকার /ডিরেক্টর। শঙ্খচিলে আমি ক্যামেরার পেছনে ফটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করলেও মূলত আমি ছিলাম অবজার্ভার! অসাধার অভিজ্ঞতা আর হাতে কলমে শেখা, একটা প্রোডাকশন কিভাবে সুন্দর করে কাজ করে আর ডিরেক্টররের ভূমিকায় তার কাজটি কেমন করে করতে হয়! যাইহোক.......আমার এই সিনেমাটির গল্প যেদিন থেকে আমার নজরে আসে সেদিন থেকেই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই যে এই সত্য ঘটনাটি দিয়ে হবে আমার প্রথম সিনেমা। নিজেই স্ক্রিপ্ট লিখতে থাকি, প্রথমে খুব ক্ষুদ্র পরিসরে গল্পটাকে ডকুমেন্টারী ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলাম, পরে ফারজানা রহমান (কপিরাইটার) আমার একজন শুভাকাঙ্খী বড় আপার সাথে গল্পটা শেয়ার করি। দুজনে মিলেই প্রথম স্ক্রিপ্ট রেডি করতে থাকি কিন্তু আপার ব্যস্ততার কারণে শেষের দিকে উনি আর সময় দিতে পারছিলেন না যার কারণে নিজেই নিজের মতো করে স্ক্রিপ্ট রেডি করি। আমার কাছের ও শুভাকাঙ্খী কিছু মানুষকে গল্পটি শেয়ার করি, ভিস্যুয়ালটা বর্ণনা করি। একদিন হীরা ভাইকে (সামসুদ্দিন হীরা, নিউজ প্রোডিউসার/জিটিভি) পুরা বিষয়টা নিয়ে যখন গল্প করছিলাম তখন তিনি আমাকে স্ক্রিপ্টটি মাসুম রেজা (স্বনামধন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার ) ভাইকে দিয়ে কারেকশন করিয়ে নিতে পরামর্শ দেন! মাসুম ভাইয়ের সাথে আমার সখ্যতা হীরা ভাই জানতেন, আমিও দেরি না করে মাসুম ভাইকে ফোন করি, দেখা করি তার সাথে। উনি অনেক আগ্ৰহ নিয়ে আমার গল্পটি শুনেন, আমি ভিস্যুয়ালটিও মাসুম ভাইয়ের সাথে শেয়ার করি, শেয়ার করি আমার ভান চিন্তা ও কি চাই! একটি পর্যায়ে মাসুম ভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে বিলে যে বিপ্লব 'গল্পটা একটা বারুদ' এইটা বিষ্ফোরণ করবে, ক্লিক করবে! শুরু থেকেই মাসুম ভাই উৎসাহ দিয়েছেন। 'ওমর ফারুকের মা'/স্ক্রিপ্টটি শেষমেশ চূড়ান্ত হয়, অনুদানের জন্য জমা দিতে উৎসাহিত করেন মাসুম ভাইই ! অনুদানের জন্য স্ক্রিপ্ট জমা দেয়ার যে আনুষ্ঠানিকতা বা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস তা আমার রেডি ছিল না। সত্যি কথা বলতে 'ওমর ফারুকের মা'র এ পর্যন্ত অনেকেই আমাকে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন । আমি যথেষ্ট আশাবাদী 'ওমর ফারুকের মা' একটি দর্শক নন্দিত ছবি হবে ইনশাল্লাহ!

 

তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

তিনি তার ভবিষৎ চিন্তাধারা সম্পর্কে বলেন, আসলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে চাই না, কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বলতে চাই যে, আমার নিজের কিছু স্বপ্ন দীর্ঘায়িত/ বাস্তবায়নের জন্য ফিল্মমেকিং এর মধ্যে দিয়ে দেশটাকে তুলে ধরা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ও সম্পদের বিপুল সমাহার বাংলাদেশ আসলেই অনেক সুন্দর একটি দেশ আমাদের আছে সমৃদ্ধ কৃষ্টি কালচার, উন্নত শিল্প -সাহিত্য, সংস্কৃতি,ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্য, লাইফস্টাইল ও অর্থনৈতিক ভাবে সম্ভাবনার একটি নুতন মাইলফলক। আমার কাজের মধ্যে দিয়ে পজিটিভলি বিষয়ভিত্তিক দেশকে। তুলে ধরা আর সেটার একটি 'বিশেষ প্লাটফর্ম সিনেমা'। নিজের একান্ত স্বপ্ন বাংলাদেশে সঠিকভাবে একটি ফটোগ্রাফি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা, ফটোগ্রাফির উপর আমার চলমান বই লেখার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা আর ভালো কিছু সিনেমা দেশকে উপহার দেয়া।

 

 

 

 

 

তথ্য সূত্র- http://bdnewshour24.com

ছবি সূংগ্রহ- আলোকচিত্রীর ফেসবুক পেইজ