এই ছবিটি বিজয় এনেছে

এই ছবিটি বিজয় এনেছে

আলোকচিত্রে টাকার হিসাবে (প্রাইজমানি) বিশ্বের সবচেয়ে দামি পুরস্কার কাতারের হিপা। এতে ‘দ্য মোমেন্ট’ ক্যাটাগরিতে এবার প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের আলোকচিত্রী কে এম আসাদ। পুরস্কারজয়ী ছবিটি তোলার গল্প বলেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ককে

 

একজন কে এম আসাদ

পুরো নাম খোন্দকার মোহাম্মাদ আসাদ। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়। ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে জুমা প্রেস ও গেটি ইমেজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। মূলত ডকুমেন্টারি (প্রামাণ্য আলোকচিত্র) করেন। নিউজ ফটোও তোলেন। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (বিপিএস) থেকে আলোকচিত্রের বেসিক কোর্স করেন। ২০০৫ সালে আসেন পাঠশালায়। এখান থেকে আলোকচিত্রে তিন বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স সম্পন্ন করেন। ক্যাননে ছবি তুলতে পছন্দ করেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তোলা ছবি দিয়ে একটা প্রদর্শনী এবং বই করতে চান আসাদ।

 

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ও আসাদ  

♦ দুটি ক্যামেরা—ক্যানন ৫ডি এমকে৪ এবং ক্যানন ৫ডি এমকে২

♦ দুটি লেন্স—৩৫এমএম এবং ১০০এমএম।

♦ লক্ষাধিক ক্লিক।

♦ প্রাথমিক বাছাই সাড়ে তিন হাজার ছবি।

♦ হাজারখানেক ছবি পাঠিয়েছেন জুমা প্রেস, গেটি ইমেজসহ বিভিন্ন এজেন্সিতে।

♦ নিজের মনমতো হয়েছে সাড়ে তিন শ ছবি।

♦ পুরস্কৃত হয়েছে অর্ধশতাধিক ছবি। হিপা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ইউনিসেফ ‘ফটো অব দ্য ইয়ার-২০১৭’ পুরস্কার।

 

রোহিঙ্গাদের ছবি তুলছি ২০১২ সাল থেকে। ২০১৭ সালে তো রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। সেপ্টেম্বরের ১৬ বা ১৭ তারিখের ঘটনা। বিকেলে শাহপরীর দ্বীপে প্রচুর বৃষ্টি ছিল। মাঝিদের কেউ একজন বলল, অপেক্ষা করেন। ওরা (রোহিঙ্গারা) রাত ১০টার পর আসবে।’ গভীর রাতে উত্তর দিক থেকে বেশ কিছু নৌকা আসতে দেখলাম। এক’শর মতো হবে। সবটিতে মানুষ বোঝাই। ভালো ছবির বুকসমান পানিতে নেমে গেলাম। ১২টা পর্যন্ত খাটলাম। কিন্তু মনের মতো ছবি পেলাম না। টেকনাফে ফিরতে রাত ৩টা বাজল। সে রাতে আর ঘুমাইনি। আজান হয়ে গেলে আবার ক্যামেরা নিয়ে বের হলাম। গেলাম শাহপরী। তুললাম বেশ কিছু ছবি। টেকনাফ ফেরার পথে ভাঙা নামে একটা জায়গা পড়ে। মাটির রাস্তা। একদম সরু। তার ওপর কাদামাখা। দেখলাম ছোট্ট একটি দল আসছে। বেশ দূরে। ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমার কাছে আসতে ওদের প্রায় আধা ঘণ্টা লাগল। ওরা আসছিল বুচিডং থেকে। কাদায় ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিল না। এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল শরীরগুলো। একেবারে সামনেরজন ও তাঁর পেছনেরজনের কোলে বাচ্চা। এগিয়ে আসার পরই ধরা পড়ল ভালো করে। তোলার পর মনে হলো, হ্যাঁ, আমি ছবিটি পেয়েছি।

 

 

সেদিনই সন্ধ্যার দিকে কক্সবাজার রওনা হলাম। রাত ১০টায় পৌঁছে প্রথমে পেটপুরে খেলাম। অনেক ছবি পাঠালাম আমি যাদের জন্য কাজ করি সেই এজেন্সিতে। কিন্তু ভাঙার ছবিটি পাঠানো হলো না। মনেও ছিল না বোধ করি। হঠাৎ একদিন হিমু ভাই (আলোকচিত্রী সুমন পাল) বললেন, ‘ভাই হিপায় (হামদন বিন মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড) ছবি দিয়েছেন?’ দিইনি শুনে বললেন, ‘না না, দিয়ে দেন।’ কোথাও প্রকাশিত হয়নি—এমন ছবি দিতে হয় হিপায়। এবার ওদের থিম ছিল ‘দ্য মোমেন্ট’। এ ছাড়া জেনারেল, স্টোরি ও ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ক্যাটাগরিতেও ছবি জমা দেওয়া যায়। আমি চারটিতেই ছবি পাঠালাম। শিরোনাম দিয়েছিলাম, Rohingya Exodus বা রোহিঙ্গাদের প্রস্থান। অক্টোবরের ৩১ তারিখ ছিল ছবি জমা দেওয়ার শেষ দিন। জানুয়ারিতে ফিরতি মেইল এলো। প্রথম তিনটি ক্যাটাগরিতে আমার ছবি মনোনীত হলো। পরে আয়োজকদের কাছ থেকে আরো তিনটি মেইল পাই। ফেব্রুয়ারিতে এলো আরেকটি মেইল, দ্য মোমেন্ট এবং স্টোরি— দুই ক্যাটাগরিতেই আমার ছবি ফাইনালিস্ট। হিপায় গ্র্যান্ডপ্রাইজ বিজয়ীকে এক লাখ ডলার দেওয়া হয়। আর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অধিকারীকে ২৫ হাজার ডলার দেওয়া হয়।

 

আগেও হিপায় লড়েছি; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভাবনাচিন্তার মধ্যেই চূড়ান্ত পর্বে যোগ দেওয়ার দাওয়াত পেয়ে গেলাম। কাতারগামী বিমানে উঠলাম ১১ মার্চ। যাওয়া-আসার সব খরচই আয়োজকদের। জেমস ন্যাটওয়ে, মোহাম্মদ মহসীনসহ আরো অনেক নামি আলোকচিত্রীদের সঙ্গে দেখা হলো। মোহাম্মদ মহসীন বললেন, ‘এবার রোহিঙ্গাদের নিয়ে করা তোমার কাজটাই ভালো লেগেছে।’ ভেবেছিলাম কিছু একটা পুরস্কার পাব। কিন্তু যখন দ্য মোমেন্টের দ্বিতীয় পুরস্কারও দেওয়া হয়ে গেল, তখন ভাবলাম সব শেষ। তার পরই সেই সময়টা এলো, আমার নাম বললেন ঘোষক, মোমেন্ট ক্যাটাগরিতে আমি প্রথম। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই দর্শক সারিতে ছিলেন। ‘বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে হাত তালি দিতে লাগলেন। একজন এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ভাই, আপনার জন্য আজ আমরা বড় হয়ে গেলাম।

 

সূত্র ও ছবিঃ দৈনিক কালের কন্ঠ