‘ফটোগ্রাফিতে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে রয়েছে’

‘ফটোগ্রাফিতে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে রয়েছে’

- আবদুল্লাহ আল আমীন (রুবেল)

 

বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (বিপিএস)-র বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইউসূফ তুষার। ফটোগ্রাফি তাঁর শখ, নেশা ও পেশা। একজন ফিল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন ফটোগ্রাফিতে। তিনি দেশে এবং দেশের বাইরেও অনেক বড় ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসরে বসেছেন। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফিকে তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বে। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা হয় বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: আপনি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সঙ্গে রয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এখন এই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আপনার চোখে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারদের অবস্থান কেমন?

ইউসূফ তুষার: বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারদের অবস্থান এখন খুবই ভালো। পৃথিবীতে যেসব বড় ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা রয়েছে সেগুলোর সব জায়গাতেই বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারদের আধিপত্য রয়েছে এবং পুরস্কারও আনছে তাঁরা। অনেক দেশের তুলনায় আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও এখানে ভালো ফটোগ্রাফারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং তাঁদের অর্জনও অনেক। শিল্প-সাহিত্যের অন্য যে কোন শাখার তুলনায় বাংলাদেশে ফটোগ্রাফি বেশি এগিয়েছে।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বিশ্বের কাছে দেশকে তুলে ধরতে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফাররা যথেষ্ট অবদান রাখছেন বলে আপনি মনে করেন কি?

ইউসূফ তুষার: অবশ্যই। নিঃসন্দেহে ফটোগ্রাফাররা এ কাজটি খুব ভালোভাবেই করছেন। খবরের ছবি হোক আর প্রতিযোগিতার ছবি হোক, দেশের ফটোগ্রাফাররা বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন প্রতিনিয়ত। অনেক কথার চেয়ে বেশি কথা বলে একটি ছবি। সেই ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বত্র তুলে ধরছেন ফটোগ্রাফাররা।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফাররা কতোটা জায়গা করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

ইউসূফ তুষার: রয়টার্স, এএফপি, এপির মতো বড় ফটো এজেন্সিতে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফাররা দেশে এবং দেশের বাইরে কাজ করছেন। একটা সময় ছিল যখন বিদেশি এনজিওগুলো বাংলাদেশে তাদের কাজের জন্য বিদেশি ফটোগ্রাফার নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। তারা বেশির ভাগ ফটোগ্রাফার নেন বাংলাদেশ থেকেই। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফাররা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়ে উঠতে পেরেছেন বলেই তাঁরা এ জায়গাগুলো নিতে পারছেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ফটোগ্রাফারদের অর্জন যদি আনুপাতিক হারে হিসাবে করেন তাহলে ফটোগ্রাফিতে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে রয়েছে।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পুরস্কার কি কি এসেছে?

ইউসূফ তুষার: ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফিয়াপ, আকু, টিএফএ-সহ আরও অনেক পুরস্কারের আয়োজন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হচ্ছে এবং আমাদের দেশের প্রতিযোগীরা সেখান থেকে পুরস্কার জিতে আনছেন। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন দেশের আয়োজনে হওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে অনেক।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারদের এই অগ্রযাত্রায় বিপিএস কতটা ভূমিকা রাখছে?

ইউসূফ তুষার: বিপিএস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। প্রয়াত আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি শুরু হওয়ার পর থেকে এদেশে সফল বড় বড় ফটোগ্রাফার যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সবাই বিপিএস থেকেই এসেছেন। এখনও সেই একই ধারা অব্যাহত রেখে বিপিএস ফটোগ্রাফারদের মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিমাসে ফটোগ্রাফারদের জন্য ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হচ্ছে। ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে মাসিক ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণের যে পথ, তা বিপিএস-ই সব ফটোগ্রাফারদের দেখিয়ে থাকে। সঠিক পথ ও গাইডলাইন বিপিএস দিয়ে আসছে শুরু থেকেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পুরস্কার যাঁরা পাচ্ছেন তাঁরা প্রায় সবাই বিপিএস-এর সদস্য।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বিপিএস বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফটোগ্রাফিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও অনেকেই দেশের ভেতর ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। সেগুলো সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

ইউসূফ তুষার: বড় আয়োজনের মধ্যে রয়েছে দ্য ডেইলি স্টার এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের আয়োজনে ‘জীবনের জয়গান’ নামের ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতাটি। এটি এক কথায় অসাধারণ। এই আয়োজনটি দশ বছর পার করে ১১তম বছরে পড়েছে। নিয়মিতভাবে এতো বড় পরিসরে এমন আয়োজন আরও অনেককে উদ্বুদ্ধ করে। এই আয়োজনটির সব থেকে ভালো দিক হচ্ছে প্রতিযোগিতার পরেও বারোটি জেলায় গিয়ে ছবিগুলো প্রদর্শন করা হয়। ফলে সেখানকার তরুণ ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও আলোকচিত্রের প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয়। আর প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্থ থেকে শুরু করে পুরস্কার তুলে দেওয়ার যে বিশাল আয়োজন রয়েছে তা পুরস্কারটিকে একটি লোভনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অনেকের কাছেই প্রতিযোগিতাটিকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু ‘জীবনের জয়গান’ খুব সহজেই এই কাজটি করে যাচ্ছে।

 

সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর শত শত ক্লাব গঠিত হয়েছে এবং তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিযোগিতার জন্য ছবি আহ্বান করছে। কিন্তু তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে না। অনেক সময় দেখা যায় ছবি আহ্বান করা পর এক্সিবিশন ফি হিসেবে নির্বাচিত ছবির ফটোগ্রাফারের কাছে থেকে টাকা চাওয়া হচ্ছে। টাকা দেওয়া হলে তবেই এক্সিবিশনে ছবি রাখা হচ্ছে। এমন অবস্থানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আয়োজকদের বাণিজ্যিক চিন্তাটা বেশি থাকে। এর ফলে এমনও হচ্ছে যে এক্সিবিশনে যাওয়ার যোগ্য নয় এমন একটি ছবি এক্সিবিশনে টিকে যাচ্ছে ফি দেওয়ার কারণে। আর ভালো একটি ছবি বাদ পড়ে যাচ্ছে ফি না দেওয়ার কারণে। এতে করে ক্ষতি হচ্ছে দুই ধরণের। প্রথমত, ওই ফটোগ্রাফার যিনি কী না ফি দেওয়ার কারণে এক্সিবিশনে ঠাঁই পেলেন তিনি জানলেন না যে আসলে ভালো বা মানসম্মত ছবি কোনগুলো। আর দ্বিতীয়ত, দর্শকরা যাঁরা এক্সিবিশন উপভোগ করতে এলেন তাঁরাও ভালো বা মানসম্মত ছবি দেখা থেকে বঞ্চিত হলেন।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: এক্ষেত্রে এই ক্লাব আয়োজিত প্রতিযোগিতায় যাঁরা বিচারক হিসেবে থাকছেন তাঁদের ভূমিকা কেমন থাকছে?

ইউসূফ তুষার: আমি বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় দেখেছি যেখানে সঠিক বিচারক নির্ধারণ করা হয় না।  যে বিষয় নিয়ে প্রতিযোগিতা হচ্ছে সে বিষয়ের ওপর দক্ষ কোন সিনিয়র ফটোগ্রাফারকেই বিচারক হিসেবে নেওয়া উচিত। কোন একজন ভালো ফটোগ্রাফারকে যদি বিচারক হিসেবে নেওয়ার জন্যে যোগাযোগ করা হয়, আর তিনি যদি ব্যস্ত থাকেন তাহলে তাঁর মাপের আরেকজনের নাম তিনিও প্রস্তাব করতে পারেন। এই বিষয়টি মাথায় রেখে যদি বিচারক প্যানেল নির্ধারণ করা হয় তাহলে  প্রতিটি প্রতিযোগিতায় বিচারকদের ভূমিকা রাখার খুব ভালো সুযোগ থাকবে এবং প্রতিযোগিতার মানও অনেক বাড়বে। অনেক ক্লাব বিপিএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন সময় বিচারক প্যানেল নির্ধারণের জন্য পরামর্শ চায়। বিপিএস সে বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করে থাকে। অন্যরা এমন সহযোগিতা চাইলে আমরা তা করতে পারি।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: এই সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে আপনারা প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য কোন নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করেছেন কি?

ইউসূফ তুষার: এগুলো নিয়ে আমরা সরাসরি বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আশার কথা হচ্ছে তারা প্রতিযোগিতা আয়োজনের আগে বিপিএস-এ এসে আলোচনা করবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং অনেকে পরামর্শ নিচ্ছেনও। আমার মনে হয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার। কিন্তু বিপিএস তো আসলে এভাবে গাইডলাইন চাপিয়ে দিতে পারে না। তবে একটি গাইডলাইন তৈরি করে সবাইকে অনুরোধ করতে পারে যে এভাবে প্রতিযোগিতা আয়োজন করলে আপনার প্রতিযোগিতার মান আরও বাড়বে। ক্লাবগুলো যদি এই গাইডলাইন অনুসরণ করে তাহলে অবশ্যই তাদের প্রতিযোগিতা মানসম্মত হবে। বিপিএস-এর একটি দল ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করছে সবাইকে একটি প্লাটফর্মে যুক্ত রাখতে। সবার সঙ্গে যাতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দ্রুত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বাংলাদেশে ফটোগ্রাফির ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন?

ইউসূফ তুষার: আসলে ফটোগ্রাফি বলতে শুধু যে সংবাদপত্রের জন্য ফটোগ্রাফি করতে হবে বিষয়টি আর তেমন নেই। এর বাইরেও ফটোগ্রাফারদের কাজ রয়েছে। ফ্রিল্যান্সার ফটোগ্রাফাররা বিভিন্ন ধরণের কাজ করছেন। তাঁরা বিভিন্ন দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন। কেউ আবার ওয়েডিং বা মডেল ফটোগ্রাফি করছেন। জীবনকে ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে ফটোগ্রাফারদের চাহিদা নিয়মিত বাড়ছে। তবে চাহিদা বাড়লেও এই ফটোগ্রাফির কোন একটি ধারাকে যদি এখন কেউ নিজের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হিসেবে নিতে চান তাহলে বর্তমান সময়ে এক ধরণের ঝুঁকি রয়েছে। এখন যে পরিমাণে পেশাদার ফটোগ্রাফার রয়েছেন সে পরিমাণে কাজ নেই। ফলে অনেক বড় বড় ফটোগ্রাফার রয়েছেন যাঁরা প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাজ পাচ্ছেন না। এর সবচেয়ে বড় কারণ নতুন ফটোগ্রাফারদের আগমনে সিনিয়রদের কাজের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতো বেশি ফটোগ্রাফার হয়ে যাওয়ার কারণে এখন পুরোপুরি ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেওয়াটি খুব বেশি ভরসার জায়গা হবে বলে আমার মনে হয় না। তারপরও যাঁরা পেশা হিসেবে ফটোগ্রাফিকে নিতে চান তাঁদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে- বিষয়টির ওপর বিস্তর জ্ঞান অর্জন করে তবেই আসবেন। এর ফলে, আপনার কাজের মূল্যায়ন যেমন বাড়বে তেমনি ভবিষ্যতে ভালো কাজ করে যাওয়ার পথ সুগম হবে।

 

 

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: ফটোগ্রাফির ওপর জ্ঞান অর্জনের জন্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান কতগুলো রয়েছে?

ইউসূফ তুষার: আমাদের এখানে পাঠশালা, সাউথ এশিয়ান ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট, বিপিএস দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট, প্রিজম ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট রয়েছে। চট্টগ্রামে ফটোব্যাংক গ্যালারি, ফটোআর্ট ইন্সটিটিউট রয়েছে। সম্প্রতি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে অপর একটি প্রতিষ্ঠান কাউন্টার ফটো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে এখন এমন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ফটোগ্রাফির ওপর বেসিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

 

Source : http://www.thedailystar.net